Monday, May 4, 2020


আজকের পাঠঃ খাদ্য খনিজ
পাঠ শেষে আমরা জানতে পারবোঃ
ক) খাদ্য খনিজ সম্পর্কে;
খ) খাদ্যে বিরল মৌলিক উপাদান সম্পর্কে;
গ) খাদ্যে বিরল মৌলিক উপাদানের বর্ণনা সম্পর্কে;
ঘ) মানবদেহে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়োডিন, আয়রনজিংকের কাজ সম্পর্কে;
ঙ) দুধমাংসের খনিজ উপাদান সম্পর্কে

uখাদ্য খনিজঃ যে সমস্ত জৈব অজৈব লবণ বা মৌলিক পদার্থ গৌণ উপাদান হিসেবে খাদ্যে উপস্থিত থেকে দেহের পুষ্টি সাধন, শক্তি সরবরাহনানাবিধ শারীরিক ক্রিয়া সম্পাদনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তাদেরকে খাদ্য খনিজ বলে

uদেহে প্রায় ২৪ টি খনিজ বা মৌলিক পদার্থ থাকে, যার সবগুলো খাদ্য থেকে আহরিতদেহ গঠনকারী ২৪টি উপাদান ছাড়াও খাদ্যে কম বেশি আরো প্রায় ৪০টি মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়

বিরল মৌলিক উপাদানঃ যে সব উপাদান দেহের জন্য অপেক্ষাকৃত খুব কম পরিমাণে প্রয়োজন এবং খাদ্যে খুব অল্প পরিমাণে (৫০ পিপিএম) এর নিচে থাকে তাদেরকে বিরল মৌলিক উপাদান বলে
অন্যভাবে, যে সমস্ত মৌলিক পদার্থ খাদ্যে অতি অল্প মাত্রায় থাকে, দেহের জন্য অল্প পরিমানে প্রয়োজন এবং মাত্রারিতিক্ত গ্রহনে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখা দিতে পারে তাদেরকে বিরল মৌলিক উপাদান বলে
বিরল মৌল সমূহকে তিনটি উপশ্রেনীতে বিভক্ত করা যায়ঃ
(ক) অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদান
(খ) অক্ষতিকর পুষ্টিমানহীন উপাদান
(গ) পুষ্টিহীন ক্ষতিকর উপাদান

অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদানঃ যে সব মৌল দেহের পুষ্টিবিধান, শক্তি উৎপাদনজীবন ধারনের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় তাদেরকে অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদান বলেযেমনঃ লোহা, তামা, আয়োডিন, ম্যাঙ্গানিজ, দস্তা
অক্ষতিকর পুষ্টিমানহীন উপাদানঃ সব মৌলিক পদার্থ পুষ্টি হিসেবে কাজ করে না কিংবা শরীরের ক্ষতি করে নাযেমনঃ অ্যালুমিনিয়াম, বোরন, নিকেল, টিনক্রোমিয়াম
পুষ্টিহীন ক্ষতিকর উপাদানঃ ধরনের মৌল উপাদান শরীরের পুষ্টি হিসেবে কোন উপকার করে না বরং দেহের বিশেষ ক্ষতিসাধন করেযেমনঃ পারদ, লেড, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়ামএন্টিমনি
বিরল মৌলিক উপাদান সমূহের তালিকা
(ক) লোহা, (খ) তামা, (গ) দস্তা, (ঘ) কোবাল্ট, (ঙ) ম্যাঙ্গানিজ, (চ) আয়োডিন, (ছ) অ্যালুমিনিয়াম, (জ) বোরন, (ঝ) নিকেল, (ঞ) টিন, (ট) ক্রোমিয়াম, (ঠ) পারদ, (ড) লেড, (ঢ) আর্সেনিক, (ণ) ক্যাডমিয়াম, (ত) এন্টিমনি

uপুষ্টিতে কতিপয় মৌল ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, কপার, কোবাল্ট, আয়রন, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, ফ্লোরিন এবং মলিবডেনাম এর গুরুত্বঃ
বিরল মৌলিক উপাদান সমূহের বর্ণনাঃ
ক্যালসিয়ামঃ উৎসঃ দুধদুগ্ধজাতা খাবার, ডিম, শিমের বিচি, ছোট মাছ, হাড়ের মজ্জ্বা ইত্যাদি
ক্যালসিয়ামের অভাবে শিশুর দৈহিক গঠন ব্যাহত হয়শিশু অপুষ্টিতে ভোগে, হাড় যথেষ্ট শক্ত হতে পারে না, ফলে অস্থি ভঙ্গুরতা দেখা দেয়বয়স্ক লোকেরা অস্থিক্ষয় রোগে ভোগেন
ম্যাগনেসিয়ামঃ মানব দেহে কোমল কোষে ম্যাগনেসিয়াম বেশি থাকেবয়স্ক ব্যক্তির শরীরে প্রায় ২৫ গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম থাকেপ্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে ১.৬ মিলিগ্রামস্বাভাবিক রক্তরসে ২-৩ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম থাকেসাধারণ সুস্থ লোকের দৈনিক ম্যাগনেসিয়ামের চাহিদা ৩০০-৪০০ মিলিগ্রামগৃহীত ম্যাগনেসিয়ামের অর্ধেক বিপাক হয়বাকি অর্ধেক মলমুত্রের সাথে নির্গত হয়
খেসারি, ছোলা, মটর, ভুট্টা, খেজুর, কলা, বাদাম, চা, কফি প্রভৃতি ম্যাগনেসিয়ামের প্রধান উৎস
ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে বিষাদ, অবসাদ, মাংসপেশীর দুর্বলতা, মাথাঘোরা প্রভৃতি দেখা যায়
সোডিয়ামঃ সোডিয়াম শরীরের অ্যাসিড-বেস ব্যালেন্সকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটি জীবের মধ্যে ওসোম্যাটিক চাপ গঠনেও ভূমিকা রাখে এবং শরীরকে জল ধরে রাখতে সহায়তা করে
দেহে সোডিয়ামের পরিমাণ হ্রাস হলে বমি বমিভাব, পেশী দুর্বলতা এবং ব্যথা, বিভ্রান্তি এবং শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যর্থতা সৃষ্টি করে
সোডিয়াম আমাদের শরীরে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেযেমনঃ
১) সোডিয়াম আয়ন দেহের অম্ল-ক্ষারের সাম্যাবস্থা বা সঠিক অনুপাত বজায় রাখে
২) সোডিয়াম অন্ত্রে শর্করাস্নেহ বস্তুর বিশোষণ বৃদ্ধি করে
৩) সোডিয়াম আয়ন স্নায়ুপেশীর স্বাভাবিক উদ্দীপনা শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে
৪) হৃদস্পন্দন সৃষ্টিচালু রাখতে সোডিয়ামে আয়ন বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে
৫) রক্তরসদেহ কলায় অবস্থিত তরল পদার্থের চলাচলের জন্য কোষঝিল্লির প্রয়োজনীয় অভিস্রাবণ চাপ নিয়ন্ত্রণ করে
পটাশিয়ামঃ মানুষের দেহে ২৫০ মিলিগ্রাম পটাশিয়ামের প্রায় সম্পূর্ণটা মাংসপেশীবিভিন্ন কলা-কোষে অবস্থিতসামান্য পরিমাণ পটাশিয়াম বহিঃকোষীয় তরলে থাকেরক্তের লোহিত কনিকায় অনেক বেশি পটাশিয়াম আয়ন থাকেদেহ-কোষের প্রধান মৌল উপাদান পটাশিয়াম
মানবদেহে পটাশিয়ামের কাজঃ
১) কোষে অবস্থিত উপাদানসমূহের কাঙ্খিত পি এইচ মান নিয়ন্ত্রণ করা পটাশিয়ামের কাজ
২) কোষ উপাদানের অভিস্রাবণ চাপ নিয়ন্ত্রণ করা
৩) সোডিয়ামের সাথে মিলে পটাশিয়াম কোষের ভিতরেরবাইরের রসে পানির সমতা ঠিক রাখে
৪) পটাশিয়াম কোষ অভ্যন্তরে কতিপয় উৎসেচকের কাজ গতিশীল করে
৫) হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক রাখতে পটাশিয়াম সাহায্য করে থাকে
ম্যাঙ্গানিজঃ বয়স্ক লোকের দেহে প্রায় ১২-২০ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ দেহ-কলাদেহ-তরলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেহাড়, বৃক্ক, যকৃত, অগ্ন্যাশয় অন্যান্য অংশের তুলনায় দস্তার পরিমাণ বেশিরক্তে ম্যাঙ্গানিজের পরিমাণ অত্যন্ত কম, প্রতি ১০০ মিলিতে মাত্র ২-৩ মাইক্রোগ্রামখাদ্য হিসেবে গৃহিত ম্যাঙ্গানিজের শতকরা মাত্র ৩-৪ ভাগ দেহে শোষিত হয়
দেহে ম্যাঙ্গানিজের কাজঃ
১) স্বাভাবিক দেহ গঠনবর্ধনে ম্যাঙ্গানিজ সাহায্য করে
২) কংকালাস্থির গঠনরূপান্তরে ম্যাঙ্গানিজ বিশেষ ভূমিকা পালন করে
৩) ম্যাঙ্গানিজ কেন্দ্রীয় স্নায়ু-মন্ডলীর স্বাভাবিক কাজ করতে তাড়না সৃষ্টি করে
৪) প্রজননে ম্যাঙ্গানিজ সাহায্য করে
আয়রন বা লোহাঃ আয়রন মানব দেহের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদানক্যালসিয়ামফসফরাসের তুলনায় দেহে লোহা থাকে অতি সামান্য; প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির দেহে ৩-৫ গ্রাম মাত্র
মানবদেহে লোহার কাজঃ
১) রক্তের লোহিত কণিকার রঞ্জক পদার্থ হিমোগ্লোবিন সংশ্লেষণে আয়রন অপরিহার্যহিমোগ্লোবিন রক্ত পরিশোধনে কাজ করে
২) জীবিত প্রাণীকোষের শ্বসনের জন্য লোহা অপরিহার্য
৩) বিপাক কাজে অংশগ্রহণকারী কতিপয় এনজাইমের উপাদান হিসেবে আয়রন খাদ্য বিপাকে পরোক্ষ সাহায্য করে থাকে
দুধের খনিজ উপাদানঃ দুধমাংসের খনিজ উপাদানের উন্নত উৎসএকই প্রাণীর রক্তদুধে খনিজ উপাদানের প্রভূত তারতম্য লক্ষ্য করা যায়যেমন, গরুর রক্তরসের প্রতি ১০০ মিলি লিটারে ৩৩০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম ও ২০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম থাকেঅথচ দুধে সোডিয়ামের চেয়ে পটাশিয়াম প্রায় তিনগুণ বেশি থাকেদুধ জ্বাল দিলে ক্যালসিয়ামফসফেট দ্রবণীয় অবস্থা থেকে কলোয়ডালে পরিণত হয়পিএইচ হ্রাস পেলে বিপরীত ঘটনা ঘটে। ৫.২ পিএইচ সম্পূর্ণ ক্যালসিয়ামফসফেট দ্রবণীয় হয়দুধের আয়তন হ্রাস পেলে সাধারণত ক্যালসিয়ামফসফেট কলোয়ডাল দশা লাভ করে

মাংসে খনিজ উপাদানঃ মাংসে প্রধানত সোডিয়াম, পটাশিয়ামফসফরাস অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণ থাকেপেশীকলায় সোডিয়ামের চেয়ে অনেকগুণ পটাশিয়াম বেশি পাওয়া যায়ক্যালসিয়ামের চেয়ে মাংসে ম্যাগনেশিয়ামও বেশি থাকেএসব খনিজ উপাদান দ্রবণীয়অদ্রবণীয় উভয় আকারে বিরাজ করেমাংসে চর্বিহীন অংশে খনিজ উপাদান মূখ্যতঃ জড়িত থাকায় চর্বিহীন মাংসে খনিজ উপাদানের পরিমাণ বেশি থাকেমাংসে দ্রবণীয় খনিজ সোডিয়াম বেশি পরিমাণে এবং ক্যালসিয়াম, ফসফরাসপটাশিয়াম কম পরিমাণে মাংসের রসের সাথে বের হয়ে যায়রান্নার সময় সোডিয়াম নষ্ট হতে পারেতাবে অন্যান্য উপাদান ঠিক থাকে
উদ্ভিদের খনিজ উপাদানঃ  সাধারণত উদ্ভিদে সোডিয়ামের তুলনায় পটাশিয়াম বেশি থাকেগমে পটাশিয়াম, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়ামসালফারের তুলনায় সোডিয়ামের পরিমাণ অনেক কমগম ভাঙ্গানোর সময় বিভিন্ন অংশের ভষ্মের পরিমাণে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়ভষ্মের পরিমাণ বেশি হলে আটা বা ময়দা গাঢ় রঙের আর কম হলে সাদা বর্ণের দেখায়খোসা ছড়ানো গমের উন্নতমানের ময়দায় ০.৩০-০.৩৫% এবং আস্ত গমের আটায় ১.৩৫-১.৮০% ভষ্ম থাকে
সয়াবিনে ভষ্মের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি, প্রায় ৫%। পটাশিয়ামফসফরাস সবচেয়ে বেশি থাকেসয়াবিনে মোট ফসফরাস ৭০-৮০% ফাইটিক এসিড হিসেবে বিরাজ করেসবজির তুলনায় ফলে খনিজের পরিমাণ কমআপেলে খনিজের পরিমাণ সবচেয়ে কম

কৌটাজাত খাবারের মাধ্যমে ধাতু গ্রহণঃ কৌটাজাত খাবারের পাত্রাধার থেকে বিভিন্ন ধাতু আমাদের পেটে যেতে পারেটিনপ্লেটিং করা পাত্র থেকে টিনলোহা, সোল্ডার করা টিনলেড গলধঃকরণ ঘটতে পারেঅধিকাংশ এসিডযুক্ত কৌটাজাত খাবার অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে টিন-লোহা জোড়ে টিন ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার হিসেবে কাজ করেএই অবস্থায় টিন অতি ধীরে দ্রবীভূত হয় এবং খাদ্যের গুণগতমান দুই বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।  কিন্তু অক্সিজেন বা জারকের উপস্থিতিতে লোহা ধনাত্মক তড়িৎদ্বার হিসেবে কাজ করে এবং টিন দ্রুত দ্রবীভূত হয়টিন দ্রবীভূত হওয়ার পর হাইড্রোজেন গ্যাস সৃষ্টি হয়ে ফুলে, ফেঁপে, ফুসে ফেটে যেতে পারে
কৌটাজাত খাবারের পাত্রাধার থেকে টিনলোহা ভক্ষণ করা একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে  দাঁড়িয়েছেখাদ্যের বিভিন্ন উপাদানের সাথে আধারের ধাতুর জটিল যৌগিক বিক্রিয়া ঘটায় নানারকম স্বাস্থ্যগত ক্ষতির আশংকা থেকে যায়

No comments:

Post a Comment